ষাট-সত্তর দশকে বেড়ে ওঠা তরুণদের যাপিত জীবন

169

১৯৬৯ সাল। তখন আলমডাংগা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি, ক্লাস এইটে। আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগীতা চলছে, ভেন্যু চুয়াডাংগা। আমরা আলমডাংগা থেকে প্রতিযোগীরা ছাড়াও দর্শক হিসেবে অনেকেই গিয়েছি। এখানে খেলা দেখার চেয়ে রুপছায়া সিনেমায় “নিলো”র ছবি দেখার আকর্ষন কোন ভাবেই বেশি ছাড়া কম নয়। কেন না আলমডাংগাতে কোন সিনেমা হল নেই, চুয়াডাংগার একমাত্র রুপছায়াই ভরসা।

যাহোক স্টেশন পাড়ার চিনা, ভোলা, রবুসহ আরো অনেকে প্ল্যান করলাম ম্যাটিনি শো দেখব। কিন্তু দুর্ভাগ্য খেলার মাঠ থেকে হলে যেয়ে দেখি শো শুরু হয়ে গেছে। কি করা, ইভিনিং শো এর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই। সময় কাটানোর জায়গা নেই, ভাবলাম পাশেই কবরী রোডে (যদিও তখন এই নামকরন হয়নি) চাচার বাসায় যাই, কিন্ত তাতে সিনেমা দেখাটাই ভুন্ডল হয়ে যেতে পারে ভেবে বিরত থাকলাম।

হলের সাথে লাগোয়া টি স্টলে থকে সিনেমার (সিনেমাকে তখন বই বলা হ’ত) গানের বই কিনে হলের পিছনে খালি জায়গায় বসে গান মকসো করতে লাগলাম। এক সময় ম্যাটিনি শো শেষ হল, আমরা মহা আনন্দে “বই “(সিনেমা) দেখা শুরু করলাম। তখনকার সময়ে আলমডাংগা থেকে চুয়াডাংগা যাওয়ার একমাত্র পথ ছিল ট্রেন, কথা ছিল সন্ধ্যার ‘রায়টা’তে ‘(লোকাল ট্রেন) করে ফিরে যাবো, কিন্তু শো বিভ্রাটের কারনে সেটা আর সম্ভব হল না। রাত ১২টার শিলীগুড়ি মেইলেই ফেরত যেতে হবে।

ছবি শেষে ছবির গান গাইতে গাইতে স্টেশনের দিকে হাটা দিলাম। স্টেশনে পৌছে ক্ষিদে চাগাড় দিয়ে উঠলো। সবাই পকেটে হাত দিয়ে দেখি কারো কাছেই তেমন পয়সা নেই। অগত্যা সামান্য যা কিছু ছিল তাই দিয়ে চা বিস্কুট খাওয়া হল। ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে সবাই মিলে বসলাম কিন্তু বিশাল সাইজের ছারপোকার কামড়ে বেশিক্ষণ টিকতে পারলাম না। প্লাটফরমেই ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। এমনিতেই সময় কাটে না, তার মধ্যে ভোলা এসে খবর দিলো শিলীগুড়ি মেইল এক ঘন্টা লেট।

এতক্ষনে বাড়ীর কথা মনে পড়ল। ফেরার কথা সন্ধ্যায়, অথচ ফিরব রাত ২টায়! আজ কপালে খারাপি আছে। কোন কুক্ষনে যে ইভিনিং শো দেখতে ঢুকেছিলাম, নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিড়তে ইচ্ছে করছে। অবশেষে ট্রেন টা হেলতে দুলতে স্টেশনে এল। আমরা সবাই হুড়মুড় করে ট্রেনে উঠলাম। কম্পার্টমেন্টটা একদম খালি, যার যেখানে ইচ্ছা বসে পড়ল। আধা ঘন্টার পথ, আমি বাংকের উপর শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষন পর ঘুম ভেংগে গেল, তাকিয়ে দেখি পুরো কম্পার্টমেন্ট খালি, ভোলা, চিনা, রবু ওদের কারো টিকিটিরও দেখা নেই।

একটা খালি কম্পার্টমেন্টে আমি একা, ভয়ে সিটিয়ে রইলাম। হঠাৎ দূরে কোথাও একটু আলোর আভাস দেখতে পেলাম। আস্তে আস্তে সেটা কাছে এলো, দেখলাম আলমডাংগার চেয়ে অনেক বড় স্টেশন, বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল। জায়গার নামটা পড়ার চেস্টা করলাম, বোর্ড খুজে পেলাম না। নেমে পড়লাম দেখি বড় করে লেখা- ঈশ্বরদী। কিছুদূর যেতেই একজন টিকিট চেকার আমাকে পাকড়াও করলো এবং যথারীতি আমার কাছে কোন টিকিট পেলো না। (এখানে বলে রাখা ভাল যে ঐ আইয়ুবীয় জামানায় ছাত্ররা থোড়াই টিকিট কাটতো, পাশাপাশি সিনেমা হলেও আই ডি কার্ড দেখালে অর্ধেক পয়সায় ছবি দেখা যেত)।

এবার আমকে চেকার সাহেব বললেন খুলনা থেকে এ ট্রেন ছেড়েছে সুতরাং তোমাকে পুরো পথের ভাড়াই দিতে হবে। আমি অনেক কাকুতি মিনতী করলাম কিন্তু ভদ্রলোক (?) আমাকে ধমকাতে লাগলেন, বললেন আমাকে বিনা টিকিটে ভ্রমনের জন্য পুলিশে দেবেন। আমাকে তিনি বড় একটা রূমে নিয়ে গেলেন, সেখানে অনেক টিকেট চেকার বসে আছেন, আমাকে একজন মোটা ভুড়িওয়ালা এবং টাকমাথা লোকের কাছে সোপর্দ করল।

লোকটি খেকিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলো কোত্থেকে এসেছিস, কি করিস? আমি পুরো ঘটনা তাকে বললাম, সে আমার দিকে চোখ কুতকুত করে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। কিন্তু কিছুই বিশ্বাস করল বলে মনে হল না। আমার সবগুলো পকেট উল্টেপাল্টে দেখল, কিছুই পেল না। তখন সে তার জামার পিঠের দিক টা উঠিয়ে বাজখাই গলায় বলল “চুলকিয়ে দে”। গা টা ঘেন্নায় রিরি করে উঠল, মনে হল লোকটাকে এক ঘুসি দিয়ে দৌড় দি, কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। অগত্যা তার ঘামে ভেজা চ্যাটচেটে পিঠ চুলকাতে শুরু করলাম।

কথায় বলে সব রাতই সকাল হয়, পাশে বসা আরেক টিকেট চেকার আমার ব্যাপারটা দেখে মনে হয় দয়ার উদ্রেক হয়। সে মোটা চেকারটাকে বলে “আপনার লজ্জা হয়না, এত টুকু একটা ছেলের সাথে এমন ব্যবহার করছেন। ছেলেটা ছাত্র, তাছাড়া ভদ্র ঘরের ছেলে বলেই মনে হয়, ছাড়ুন ওকে।” মোটকু টা কিছুটা মিইয়ে যায়, দয়ালু চেকার আমাকে নিয়ে বাইরে আসে, জিজ্ঞেস করে তোমার বাবা কি করে? আমার বাবা একজন সরকারী কর্মকর্তা এবং আলমডাংগায় কর্মরত আছে শুনে ভদ্রলোক আমাকে পরের ফিরতি ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে ঐ ট্রেনের একজন টিকিট চেকারকে বললেন আমাকে আলমডাংগায় নামিয়ে দিতে। আর আমাকে বললেন “খোকা অল্প দুরত্বের জার্নিতে কখনো ঘুমিয়ে পড়বেনা”। বাসায় ফিরলাম সকালে। তারপর কি হল? সে আরেক কাহিনী।