আলমডাঙ্গা গণহত্যা: পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার রক্তভেজা দলিল!

332
আলমডাঙ্গা বধ্যভুমি

আলমডাঙ্গা গণহত্যা; একাত্তরের মধ্য এপ্রিল। ১৪-১৭ তারিখের মধ্যে পাকিস্তানি আর্মি থানা শহর আলমডাঙ্গা দখল করলো। সম্ভবত ১৪ তারিখেই আলমডাঙ্গার পতন ঘটলো। সেনা লরির আওয়াজ আর ভারী বুটের শব্দে এই অঞ্চলের সবখানে সে কী আতঙ্ক। জনশূন্য হয়ে গেল ছোট্ট এই শহর। এর আগে ৩০ মার্চ তাজউদ্দিন আহমদ চুয়াডাঙ্গায় এসে পৌঁছে গেছেন, বিকালে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে গেছেন সাথে (কুস্টিয়ার) ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।

৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা শহরে বিমান হামলা করলো ওরা। থমথমে পরিবেশ সবখানে। ঢাকায় খান সেনারা গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ চুয়াডাঙ্গার অবাঙালি মহকুমা প্রশাসক মোহম্মদ ইকবালকে আটক করার পর সে নিহত হলো। তারপর সদর থানার সার্কেল অফিসার হাবিব রসুলকে চুয়াডাঙ্গার এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হলো।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর ৩০ ও ৩১মার্চ কুস্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে আওয়ামীলীগ নেতা দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গণের প্রধান উপদেষ্টা ডা.আসহাব-উল হক হেবা, উপপ্রধান উপদেষ্টাদ্বয় আলমডাঙ্গার ব্যারিস্টার বাদল রশীদ (আবু আহমেদ আবজালুর রশিদ ওরফে বাদল রশীদ) ও চুয়াডাঙ্গার ইউনুস আলী এ্যাডভোকেইট এর নেতৃত্বে গঠন করা হাজার হাজার আনসার, মুজাহিদ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে এই রণাঙ্গণের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, সহ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলো।

ব্যারিস্টার বাদল রশীদকে নিয়ে একটি লেখাঃ আমার দেখা ব্যারিস্টার বাদল রশীদ

বিভিন্ন জায়গায় অবস্হান করা মুক্তিবাহিনীর জন্য তৈরি খাবার সরবরাহের নেতৃত্বেও ছিলেন ডা.আসহাব-উল হক। অবশ্য বাদল ব্যারিস্টার ২৭ মার্চ ভারতে রওনা হয়ে গেছেন দেশের পক্ষে প্রচার চালাতে। লন্ডনে পূর্ব বাংলা মুক্তি সংঘের সাথে ঘনিষ্টভাবে কাজ করেন। তিনি পুনর্বাসন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।

এদিকে আলমডাঙ্গা থানা আনসার বাহিনীর আলমডাঙ্গা সার্কেলের দায়িত্বে ছিল সহকারি এ্যাডজুটান্ট আবুল কাশেম। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেকে নিহত হলো। অনেকে যার যার মতো পালানোর চেষ্টা করে ধরা পড়ে গ্রামের মানুষের হাতে বর্শা বল্লমের খোঁচায় মারা পড়লো। একেক দল একেক জায়গায় নিহত হলো। কেউ গাড়াগঞ্জ, আবদালপুর, ঝাউদিয়া, কালিদাসপুরে মারা পড়ে।

পয়লা এপ্রিলে আতাউল্লাহ নামের অল্প বয়সী এক পাঠান অফিসারকে ধরে চুয়াডাঙ্গায় আনলো। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে অনেকে আহত হলো, শহীদ হয়েছে কয়েকজন। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা মুক্তিকামী মানুষকে সাথে নিয়ে আরো অনেক নেতা এই প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন।

যাদের নাম মনে পড়ে তাঁরা চুয়াডাঙ্গার মীর্জা সুলতান রাজা, এ্যাডভোকেইট জাকারিয়া, দোস্ত আনসারী, কবু জোয়ারদার, আল্লা হাফিজ, হাশেম মোক্তার, মোহম্মদ শাহজাহান, চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ফুলে হোসেন, সেলুন জোয়ারদার, কুস্টিয়ার আবদুর রউফ চৌধুরী, আমিনুল হক বাদশা, রশিদুজ্জামান দুদু, নুর আলম জিকু, রাজা মিয়া, অধ্যক্ষ দেওয়ান আহমেদ, গোলাম কিবরিয়া, শামসুল হাদী।

মেহেরপুরের মোহম্মদ সহিউদ্দিন (সংস্হাপন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের পিতা), ইসমাঈল হোসেন, ইদ্রিস আলী, এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ঝিনেদার এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ও ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক সফিকউল্লাহ। আলমডাঙ্গার শাফায়েত-উল ইসলাম, ডা.সাহাবুদ্দিন(সাবু ডাক্তার), বাবু বিমল পাল, কাজী কামাল, রশীদ মোল্লা, আনোয়ার আহমেদ আনু, মুন্সিগঞ্জের মকবুলার রহমান। পরে পাবনার ডিসি নুরুল কাদের এপ্রিলে চুয়াডাঙ্গায় এসে যুক্ত হন।

আলমডাঙ্গায় একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম ও গণহত্যা নিয়ে জানতে চাইলে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ডা.আবদুল হামিদ স্মৃতি থেকে বললেন উপরিউক্ত কথাগুলো।

এরপর জানালেন, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে যারা অগ্রগণ্য তাঁরা ডা.শামসুজ্জোহা কোরেশী, ডা.করিম. ডা.আফিল, ডা.মোজাম্মেল, ডা.মোকসেদুর রহমান, ডা.সাইদ জোয়ারদার সহ আরো কিছু চিকিৎসক। ডা.বোস রেডক্রসের পক্ষ থেকে আহত স্বেচ্ছাসেবকবাহিনীর জন্য ওষুধসামগ্রী উপহার দিলেন। ৩ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি জন্মলাভ করলো। এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হলেন ডা. আসহাব-উল হক ও ডা.কোরেশী হলেন মহাসচিব।

ডা. হামিদের ভাষ্যে, ৩০মার্চ কুস্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে ওষুধ, গজ-ব্যান্ডেজ সাথে রেখে প্রতিদিন আনোয়ার আহমেদ আনুকে আমার মোটর সাইকেলের পিছনে বসিয়ে নিজের ঘাড়ে পয়েন্ট ২২ বোর রাইফেল নিয়ে পোড়াদহ-কুস্টিয়া গেছি। প্রকাশ্যে নিজের ঘাড়ে রাইফেল রাখা কতটা ঝুঁকি তখন ওতো ভাবিনি। মনে হয়েছে প্রয়োজনে রাইফেল তাক করে শত্রুর বিপক্ষে লড়তে পারবো।

তিনি বলেন, “পরবর্তীতে ১৪ এপ্রিল ভেড়ামারা, ১৫ এপ্রিল ঝিনেদা ও কুস্টিয়া খান সেনাদের দখলে চলে গেল সেকারণে ঐদিন চুয়াডাঙ্গা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের রণসদর দপ্তর মেহেরপুর সরিয়ে নেয়া হলো।যখন ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা,মেহেরপুরের পতন ঘটলো তখন রণসদর দপ্তর আবার মেহেরপুর থেকে ইছাখালিতে সরানো হলো। তবে এই অঞ্চল পতনের আগে ৩০মার্চ কুস্টিয়ার যুদ্ধ, ৫ এপ্রিল বিষয়খালির যুদ্ধ ও ৭ এপ্রিল লেবুতলার যুদ্ধে জয় পেয়ে মুক্তিবাহিনীর মনোবল চাঙ্গা হয়ে উঠলো।”

বললেন- ‘১০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্হায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হবে এমন খবর প্রচার হয়ে গেলে ১৫ ও ১৬ তারিখে আবার বিমান হামলা শুরু হলো। নিরীহ মানুষজনের ওপর হামলার কারণে চুয়াডাঙ্গা থেকে মানুষ যে যার মতো পালাতে থাকলো। দখলদার বাহিনী ১৬ এপ্রিল ঝিনেদা থেকে চুয়াডাঙ্গা আসার পথে সড়কের আশেপাশের দোকান-পাট,হাট-বাজার,বাড়ি-ঘরের নিরীহ মানুষদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে চুয়াডাঙ্গা শহরে সন্ধ্যা নাগাদ ঢুকে পড়লো। ঐদিন অনেক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। ১৬ এপ্রিলের রাতটা খুব দুর্যোগের ছিল। ঝড়-বৃষ্টি কাদা পানিতে রাস্তাঘাট একাকার। কী যে দুঃসময় তখন।

’মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শাফায়েত মিয়াদের নির্দেশে সম্ভবত এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তায় সকালে আলমডাঙ্গা কলেজের কন্ট্রোলরুম বন্ধ করে দিয়ে মাইকিং করে জানানো হলো, সকলকে যার যার মতো নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে। আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের কাছে ওয়াপদা কলোনীর পূবদিকে ও কালিদাসপুর লাল রেল ব্রিজের কাছে খান সেনারা ঘাঁটি তৈরি করলো।

ডা. বজলুল হকের বাড়ির সামনে থানা কাউন্সিলে ক্যাম্প বসালো। একটা সময় ডা.বজলুল হকের ডিসপেনসারির একাংশ ওরা দখলে নিলো। চারতলা ভবনে রাজাকারদের ক্যাম্প হলো, ঐ ভবনের ছাদে খানসেনারা অস্ত্রতাক করে টহল দিতো। আন্দিয়া বাবুর বাড়িতে মিলিশিয়া পুলিশ ক্যাম্প ও আনন্দধাম ক্যানেল ব্রীজে রাজাকার ক্যাম্প হলো। এখানকার নিরীহ মানুষকে মেরে ফেললো, নির্যাতন করলো, বাড়িঘরে আগুন দিলো।

পাকিস্তানি আর্মি উচ্চ বর্ণের হিন্দু মেয়ে ও মুসলিম অভিজাত মেয়েদের ট্রেন থেকে নামিয়ে ওয়াপদা’র বাংলোয় রেখে নিয়মিত নির্যাতন করতো যাতে তাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানি সন্তান পয়দা হয়।যখন বুঝতো ঐ মেয়েদের দিয়ে ওদের উদ্দেশ্য পূরণ হবে না তখন দিনের পর দিন ওয়াপদা’র দারোয়ানদের হলদে রঙের কোয়ার্টারে নিয়ে সৈন্যদের দিয়ে বিভৎস অত্যাচারের পর হত্যা করে গার্ড কোয়ার্টার সীমানার গণকবরে ফেলার হুকুম দিতো।তখন পাকিস্তানি মেজর রানার নাম খুব শোনা যেত।

আলমডাঙ্গাতে একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম ও পাকিস্তানি খান সেনাদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানালেন,

”যেদিন ওরা আলমডাঙ্গা দখল করলো সেদিন তৎকালিন ডাউকি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিনোদপুর গ্রামের আবুল হোসেন, বাবু গঙ্গাধর জালানের ভাই পুষ্কর জালান, দোয়ারকা বাবুসহ এক পুলিশকে হাটবোয়ালিয়া গ্রামের মাথাভাঙ্গা নদীতে নিয়ে হত্যা করে। ঐদিন আলমডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোবিন্দপুর গ্রামের আওয়ামীলীগের ডা.শমশের আলী মিয়াকে ধরে নিয়ে যায়,পরে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছেন তিনি।না জেনে ভদুয়া গ্রামের মুসলিমলীগার মকছেদ চৌধুরিকে ধরে নিয়ে যায় ওরা,পরে ফিরে আসেন তিনি।যুদ্ধের শেষের দিকে হানাদাররা গোবিন্দপুরের হরেকৃষ্ণকে মেরে ফেললো।”

যুক্তফ্রন্টের রাজনীতির শুরু থেকে যুক্ত থাকা প্রবীণ ব্যক্তি হরিণাকুন্ডু থানার আমিরুল ইসলাম বলেন-

“কুস্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধের আগে ভাংবাড়িয়া ও আশপাশের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের সাথে চুয়াডাঙ্গার তৎকালিন ইপিআর প্রধান মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর আলোচনা সভা হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তিনি আসতে পারেননি,সভাও হয়নি।কিন্তু এই গোপন খবর জানাজানি হলে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত বগাদি গ্রামের একজন সামরিক পোশাকে ভাংবাড়িয়া গ্রামে এসে আওয়ামীলীগ নেতা চেয়ারম্যান হেফাজউদ্দিন বিশ্বাস ও তাঁর বড়ছেলে রতন ও খালেক নামের একজনকে (খালেক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের না) চুয়াডাঙ্গায় ধরে নিয়ে যায়। শোনা গেল পরে তাদেরকে মাথাভাঙ্গা নদীর পাড়ে নিয়ে হত্যা করে খানসেনা ও রাজাকার বাহিনী।”

আমিরুল ইসলামের ভাষ্যে, ‘তবে আলমডাঙ্গা থানা কাউন্সিল চত্বরে উপস্হিত হলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। বিপুল জনসমাগম তখন। সেখানে হাজির হলেন সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ডা.বজলুল হক। ’ডা.হামিদ বলেন, রাজাকাররা গরীব হিন্দুদের কাপড়-চোপড় ধান-চাল, গরু,টিনের চালা, শোয়ার চৌকিটাও লুট করেছে। জমিজিরেত জোর জবরদস্তির টিপসই নিয়ে কেড়ে নিয়েছে। কুস্টিয়ার যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিবাহিনীর জন্য নিজের গ্রামের ছেলেমেয়েদের দিয়ে জোগাড় করা শুকনো খাবার, রুটি, গুড় আলমডাঙ্গার ডাকবাংলোতে পাঠানোর কারণে দুর্লভপুর গ্রামের ডাক্তার জগবন্ধু আচার্যের বাড়িঘর তছনছ করে তারা।

এই অঞ্চলের সব ঘরে ঘরে ঐ কয়দিন তখন মেয়েদের রুটি ও শুকনো খাবার বানানোর হিড়িক পড়েছিল। কুস্টিয়া চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর ঝিনেদার এতোবড় অঞ্চলের মা-মেয়েদের সহযোগিতার কারণে কুস্টিয়ার যুদ্ধ জয় সহজ হয়ে যায়।

কুস্টিয়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর জন্য খাবার পাঠাতে আলমডাঙ্গার ডাকবাংলোতে রান্নাবান্নার আয়োজন করা হয়। গোবিন্দপুরের হারেস সরদার রান্না করতো। আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সাথে থেকে ডা.বজলুল হক এসবের তদারকিতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের এই কর্মযজ্ঞের সাথে ছিল ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার নজর আলী। সম্ভবত এসবের ছবি তুলে পরে খানসেনাদের দেখানো হয়।

খান সেনারা রেলস্টেশনের বাইরে লাল রেলব্রীজের কাছে ট্রেন থামিয়ে নিরীহ পুরুষ যাত্রীদের মুক্তিযোদ্ধা কিনা প্রমাণের জন্য তল্লাশির নামে তাদের সম্পদ লুট করতো, এরপর পুরুষদের নামিয়ে নিয়ে মেরে ফেলার পর রেলওয়ের লালব্রীজ ও কালিদাসপুর এলাকার গণকবরে ফেলে দিতো। মেয়েদেরকে ট্রেন থেকে নামিয়ে ওয়াপদা’র দারোয়ানদের হলদে রঙের ঘরে নিয়ে নির্যাতন নিপীড়ন শেষে হত্যা করতো।

এরপর বলেন, নান্নু মোল্লা ও মনু মোল্লা, আনোয়ার আহমেদ আনু (বজলু ডাক্তারের ভাগ্নে), আব্দুল হান্নান রতন, ফরহাদ, সেলিম, সবেদ আলী, জকু, নুর মোহম্মদ, সুলতান জোয়ার্দার, কলেজপাড়ার রমজান, টগর এবং ওর আত্মীয় আশু, দুলাল, মারফত, আব্দুল মাবুদ, ইমাদুল, অনুপনগরের রবিউল, কালিদাসপুরের মাঈনুদ্দীন, কুদ্দুসসহ অন্যান্য গ্রামের ছেলেমেয়েরা ইতোমধ্যে যুদ্ধে গেছে।

জুন মাসে গোবিন্দপুরের মফিজউদ্দিন বিশ্বাস নিহত হলে রাজাকার ও খানসেনারা ডা.বজলুল হকের ভগ্নিপতি ব্রিটিশ রেলওয়ের গার্ড শামসুদ্দিন আহমেদ (শাম গার্ড) কে চাপ দিতে থাকে বজলুল হক কে তাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য। না দিলে পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় কিন্তু তাঁকে খানসেনা ও রাজাকারদের হাতে তুলে দেয়া হয়নি। তখন ডা.হক কে কুস্টিয়ার আড়পাড়া গ্রামে রাখা হয় এবং সেখান থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়।কিন্তু ঢাকায় তিনি বেশিদিন না থেকে ফিরে এসেছেন আলমডাঙ্গায়।

জুন মাসের মাঝামাঝি একদিন ডা.বজলুল হকের মেজো ছেলে সনজুকে লতিফ দারোগা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেল। এরপর পরিবার থেকে সে বিচ্ছিন্ন। পরে যশোর থেকে বন্দীদশা মুক্ত হয়ে সেপ্টেম্বরে বাড়ি ফেরার সুযোগ মেলে তার। চেনা যায় না সনজুকে। গালভর্তি দাড়ি, উসকো খুসকো চুল; ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা। একদিন ডা.বজলুল হকের বাড়ি রেইড দেয় পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনী, যাকে ঝটিকা হামলা বলে। সারাবাড়ি ঘিরে ফেলে। ডিসপেনসারি ও বাড়ির সবকিছু তন্ন তন্ন করে লুটপাট চালায়। তছনছ করে দেয় সবকিছু। তারপর ডা. হককে থানায় নিয়ে যায় এরপর চুয়াডাঙ্গাতে পাঠায়। দুইদিন পর উনাকে ফেরৎ দেয়। ঐদিন আমাকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে পরে ছেড়ে দেয়।

অতঃপর ডা.হামিদ বলেন, ১৪ অগাস্ট,১৯৭১।সকালে ডিসপেনসারির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।আগের দিন শুকচা বাজিতপুরের যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা টগরের মরদেহ গরুর গাড়িতে বাঁশের সঙ্গে পা উপরে বেঁধে ঝুলিয়ে আলমডাঙ্গা শহরের স্টেশন রোড থেকে চারতলা মোড়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এক বিহারি।যেতে যেতে আমাকে দেখে বিহারি কটাক্ষের সুরে ‘তুমি’ সম্বোধন করে বলে,তোমাদের লোক সে তোমাদের লোক। আমি ডিসপেনসারিতে ঢুকে পড়ি।

তারপর টগরের মৃতদেহ চারতলার মোড়ে নিয়ে খুঁটির সাথে দু’পা উপরের দিকে বেঁধে মনে হয় দুই দিন ওভাবে রেখে দেয়ার পর জিকে ক্যানেলের ধারে শহীদ টগরকে মাটিচাপা দেয়। ঐ বিহারিকে স্হানীয় রাজাকার, শান্তি কমিটির উচুঁ পর্যায়ের মেম্বররাও ভয় পেতো। না জানি ওর মতের বিরুদ্ধে গেলে তাদেরকেও শেষ করে দেয় কিনা।

৭ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার শবে-বরাতের দিন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ইউসুফ মিয়া তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিহত হলেন। পরদিন সকালে হঠাৎ ডা.বজলুল হকের বাড়িতে খান সেনাদের আক্রমণ। শবে-বরাত উপলক্ষে সারারাত নামাজ শেষে সকলে যার যার ঘরে ঘুমে। ওরা সারা বাড়ি কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে সব শেষ করে দিলো। বাড়িটায় দুই বার এমনভাবে আগুন লাগালো যা বাস করার মতো থাকলো না।

প্রথমে আগুন জ্বালিয়ে ওরা চলে গেল। আবার ফেরৎ এসে তা কেনো নেভানো হলো সেই অপরাধে পরিবারের এক ছেলেকে রাইফেলের বাট দিয়ে পিঠে বেদম আঘাত করলো। বাবা রে.. মা রে.. বলে তার গগণবিদারী চিৎকার। নয় মাস কোনো স্বস্তি ছিল না মানুষের মনে। রাজাকার ও খানসেনাদের অত্যাচারে আতঙ্কিত এলাকার মানুষ।

প্রায় রাতে আমরা মাইন বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনতাম। পরে জানা হয়ে গেল খান সেনা ও রাজাকারদের ভয়ে রাখতে মুক্তিফৌজের দল বিস্ফোরণ ঘটাতো। রাতের অন্ধকার ছিল আমাদের জন্য কিছুটা স্বস্তির কারণ মুক্তিযোদ্ধারা রাতে বের হতো। খান সেনারা রাতে ভয়ে বের হতো না। তিনি বলেন, সেদিন ছিল ১২ নভেম্বর শুক্রবার। বোধ হয় ১৩৭৭ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাস। ২২ রমজান। এদিন আলমডাঙ্গা শহরে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি আর্মির যুদ্ধ শুরু হয়।

এই যুদ্ধে স্টেশনপাড়ার বাহার আলী মোল্লার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা নান্নু মোল্লা ডা.হকের বাড়ির পাশে পাডিয়া স’মিলের পিছনে খান সেনাদের গুলিতে শহীদ হলো। মুক্তির আনন্দে রাইফেল খাড়া করে ডা.হকের বাড়ির সামনে দিয়ে থানা কাউন্সিলের দিকে যেতে মিলিশিয়া বাহিনীর গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা আশু নিহত হয়। ঐদিনই তাহেরহুদা ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামের আবদার (আবদার রহমান জোয়ার্দার সম্পর্কে কর্ণেল কায়রোর ভগ্নিপতি) বাহিনীর যোদ্ধা দামুড়হুদা থানার আনসার আলী নিহত হলো।

সরকারি খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা গফুর সরদার সাহেবের ছেলে দুলাল (যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলাল) ও পাঁচলিয়া গ্রামের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জামাল উদ্দিন আহত হলো। পুরো শহরে ভুতুড়ে পরিবেশ। এই পরিবেশে আমি খুব অসুস্হ এক রোগীকে চিকিৎসা দিতে বেরিয়ে গেছি। কিছুক্ষণ থেমে জানালেন, “যেদিন যুদ্ধ শুরু হলো তার ৮/৯ দিন পর ঈদ। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা ছিল ঈদের নামায শেষে রাজাকারদের ক’জনকে জীবিত ধরে এনে ওদের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করা। কিন্তু হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পরে জানা গেল মুক্তিযোদ্ধাদের এই পরিকল্পনা রাজাকাররা কোনভাবে জেনে খান সেনাদের জানিয়ে দেয়। যার ফলে আগেভাগে যুদ্ধ শুরু হইছে।”

সারাদিন থেমে থেমে যুদ্ধ চলছিল। এমন সময় দুপুরে দখলদার বাহিনীর একটা দল রাজাকারদের সাথে নিয়ে ডা.বজলুল হক এর বাড়িতে অতর্কিতে হামলা চালায়। নিরস্ত্র স্বাধীনতাকামী এই মানুষকে টেনে হিঁচড়ে পাশে তার বোনের বাড়ির উঠোনে নিয়ে হত্যা করে। এরপর বড় ছেলে মনজুকে থানায় ধরে নিয়ে গেল। পরে রাজাকারদের কারো অনুরোধে মা হারা অনেকগুলো ছোট ভাইবোনের কথা ভেবে মনজুকে ছেড়ে দেয়। ওদের আব্বাকে কবরে শোয়ানোর সুযোগ দেয়নি খানসেনারা। তাঁর নিথর দেহ নির্জন উঠোনে চাদরে ঢেকে রেখে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে সবাই।

শহীদ ডা. বজলুল হক ও তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোল্লা আবুল হোসেন নান্নু, আশরাফ আলী আশু ও আনসার আলীকে তৎকালীন থানা কাউন্সিল এলাকার এক কোণে গণকবরে মাটিচাপা দিয়ে রাখে ওরা। দেশ স্বাধীন হলে ক্যানেলের পাশ থেকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জামসেদ নূরী টগরকে তুলে এনে চার শহীদের সাথে সমাহিত করা হলো। এরপর ডা. হামিদ জানালেন, দেশ স্বাধীনের পর ডা. হকের ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরে দেখে ডিসপেনসারির সবকিছু লুট হয়ে গেছে। বাড়ির ভিতর পোড়া গন্ধ। জানালা দরজা আসবাব সবকিছু আধা পোড়া। পুরো বাড়ি খাঁ খাঁ করছে। পরিশেষে তিনি বলেন,

“আলমডাঙ্গাকে ধ্বংস করে ৭ ডিসেম্বর বর্বর যুদ্ধাপরাধী পরাজিত খান সেনারা এই জনপদ ছেড়ে গেল বটে কিন্তু জেনোসাইড ঘটিয়ে যে দগদগে ঘা এর চিহ্ন রেখে গেল যা অন্য চিহ্ন এসে কি মুছতে পারবে?

প্রত্যক্ষদর্শী ডা. আবদুল হামিদ ও আমিরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের সময় আলমডাঙ্গা গণহত্যা -র ঘটনা সংক্ষেপে যতটুকু বলেছেন এমন বর্বর নিষ্ঠুরতার ঘটনা সারা বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যার একটি নমুনা চিত্র। একাত্তরের গণহত্যায় বিভিন্ন ধরনের নৃশংসতার যত উপাদান পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে, সারা বিশ্বের মানুষ তা জেনে হতচকিত হয়েছে। একাত্তরে বাংলাদেশে যে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও জেনোসাইডের ঘটনা ঘটেছে তার প্রমাণ মিলেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে। সেই তথ্য উপাত্ত এখন জেনোসাইড সংঘটনের দলিল।