প্রেক্ষাপট ১
আব্বা ঢাকা যাচ্ছেন অফিসের কাজে। আমিও বায়না ধরলাম। অগত্যা আব্বা আমাকে সাথে নিয়েই ঢাকা রওনা হলেন। তখন সুন্দরবন নামে একটা ট্রেন ছিল, বাহাদুরাবাদ ঘাট পার হয়ে কমলাপুর আসতো । অনেক রাতে ট্রেন কমলাপুর পৌছালো। আমরা বাপ বেটা খবরের কাগজ পেতে প্লাটফরমে শুয়ে রাত পার করে সকালে বাংলাদেশ কৃষক লীগের অফিসে গেলাম। পরের কয়েকটা দিন ওখানেই ছিলাম। তখন আলমডাঙ্গা চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের অনেকেই ঢাকায় গেলেএই অফিসে রাত্রি যাপন করতেন। ঢাকায় তখন তেমন হোটেলের চল ছিল না।
‘ব্যারিস্টার চাচা’ কোথায় যেন সরকারি অনুষ্ঠানে যাবেন। টাই পরা। আমি সেই প্রথম টাই দেখে বিস্মিত হই। আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম ওঁর গলায় ওটা কী। আব্বা বললেন, “নেকটাই। ব্যারিস্টাররা পরে।” আমি টাই ও বুঝি না ব্যারিস্টারও বুঝি না ! তবু চুপ করে থাকলাম। আমি তখন ৮/৯ বছরের শিশু।
প্রেক্ষাপট ২
শিশুকালে তাঁর টাই দেখে অবাক হওয়ার পর তাঁকে ভুলেই গিয়েছিলাম। মাঝখানে আব্বার বদলির সুবাদে এখানে ওখানে ঘুরে আলমডাঙ্গায় এলাম ক্লাস টেনের একেবারে শুরুতে। ১৯৮১ সালের প্রথম দিকে ।
তখন অরুন চাচা ছাত্রলীগ করেন। আলমডাঙ্গার নজরকাড়া তরুণ। তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক শুরু কুমারখালি থেকে। আব্বা কুমারখালি চাকরি করতেন, আমি তখন ক্লাস এইট/নাইন। ওঁর বড় ভাই জয়নাল চাচা ছিলেন আব্বার বন্ধু, তিনিও কুমারখালিতে চাকরি করতেন, আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। সেই সুবাদে অরুনও আমার চাচা। তাঁর মা আমার দাদি। কিন্তু চাচা হলেও বরাবর তাঁর সাথে আমার এক অদ্ভুত সুন্দর সম্পর্ক। আমার জীবনের অনেক বিপদে তিনি পাহাড়ের মতো পাশে দাঁড়িয়েছেন। সে সব কথা আরেকদিন বলা যাবে। যা হোক, আমার প্রতি তাঁর একটা প্রশ্রয়ও টের পাই। আমিও সাহস করে ভাতিজার জন্য প্রযোজ্য অধিকারের বেশিই দাবী করি। দাবী আদায়ও হয় ! অধিকার থাকা সত্ত্বেও কখনো আমাকে ছাত্রলীগ করার জন্যে জোর করেননি। তবে ছাত্রলীগ করলে যে তিনি খুশি হবেন, তা বুঝতাম।
সামনে ছাত্রলীগের সম্মেলন। কাজি রবিউল সভাপতি প্রার্থী, অন্যান্য প্রার্থী তালিকায় আছে স্বপন চৌধুরি, আনসার ভাই প্রমুখ। শরীফ ভাইকেও ঐ সম্মেলনে দেখেছি। যতদূর মনে পড়ে তিনি তখন কুস্টিয়া কলেজের ছাত্র ছিলেন । শহীদ ভাইয়ের বাড়িতে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। তবে তার আগেই স্কুল কমিটিগুলো শেষ করার তাগিদ ছিলো। আমি হলাম আলমডাঙ্গা স্কুল কমিটির সভাপতি আর আসাদুল হলো সম্পাদক। আমার ছাত্রলীগের স্কুল শাখার সভাপতি হওয়ার পিছনে অরুন চাচাকে খুশি করার ইচ্ছাটা একটা বড় কারণ ছিলো। যা হোক, আমরা ভোট দিয়ে কাজি রবিউলকে থানা ছাত্রলীগের সভাপতি বানালাম। তবে সম্মেলনে আমার মন কাড়লো, স্বপন চৌধুরি। তার চেহারা, বাচনভংগী আর সাহসী কথাবার্তা আমাকে মুগ্ধ করলো।
সেই সম্মেলনের আগে বা পরে কোন এক সময়ে ব্যারিস্টার সাহেবকে আবার দেখলাম। একটা ফিফটি সিসি হোন্ডা বাইকে (নীল সাদা রঙ ছিলো, তখনই ভগ্নদশা) তিনি আলমডাঙ্গা আসতেন। তখনো পাকাপাকি আলমডাঙ্গায় থাকা শুরু করেননি। তাঁকে দেখে দ্বিতীয়বার বিস্মিত হলাম এই কারনে যে, প্রথমত তাঁকে আলমডাঙ্গায় দেখবো এটা ভাবিনি। তাঁর টাই নেই, জামা প্যান্ট কুঁচকানো, পুরনো, জুতোও চকচকে নয়। অথচ তাঁকে ঘিরে কেমন একটা সমীহ যেন বিরাজ করছে সবখানে । সবাই খুব মানছে তাঁকে, কিন্তু কেউই ভয় পাচ্ছে না । তিনি একই সাথে সাধারণ এবং অসাধারণ। তিনি একই সাথে মানুষের বন্ধু আবার গুরুজন। কথাবার্তায় একদম চোস্ত কোনো ভাব নেই, একেবারে আলমডাঙ্গান উচ্চারণ। অবাক হোলাম ! মানুষটা এমন ‘গ্রাম্য’হলো কেমন করে !!!
প্রেক্ষাপট ৩
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ আমাদের এসএসসির বায়োলজি পরীক্ষা ছিল। শেষ পরীক্ষায় ঐদিন সকালে যখন বাড়ি থেকে বেরুচ্ছি আব্বা বললেন লেফটেনেন্ট জেনারেল হসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সামরিক আইন জারি করেছেন। ভালো বুঝি নি কী হলো। বাইরে বেরিয়েও আলাদা কিছু টের পাই নি।
পরীক্ষা শেষ। জুন মাসের দিকে ঢাকায় বেড়াতে গেলাম। আমার জীবনের তৃতীয় বারের মতো ঢাকায় যাওয়া। অরুন চাচার সাথে টিএন্ডটি কলোনীতে দেখা হলো। উনি তখন সেখানে উনার ভাইয়ের বাসায় থাকেন, কলেজে পড়েন। উনার ভাতিজা মামুনের সাথেও আলাপ হলো। আমার চেয়ে বয়সে বড়, চাচার চেয়ে একটু ছোট, ভীষন স্মার্ট। ঢাকার যা দেখি তাতেই মুগ্ধ হই। প্রথম দেখাতে মামুনকেও খুব পছন্দ হলো। চাচা আমাকে নিয়ে ঢাকা দেখাতে বেরুলেন। গুলিস্তান সিনেমা হলের পাশে, যেখানে কামানটা ছিল, তাঁর পিছনে একটা কনফেকশনারিতে আমাকে কেক আর কোক খাওয়ালেন। সেই আমার প্রথম কোক খাওয়া। তারপর লালবাগের কেল্লা দেখতে গেলাম রিক্সায়।
এসএসসিতে রেজাল্ট মোটামুটি ভালই হলো। অরুন চাচা আমাকে নটরডাম কলেজে চেষ্টা করতে বললেন। বাড়িতে রাজি হলো না তাই আলমডাঙ্গা কলেজেই ঢুকলাম। ছাত্রলীগ করছি কিন্তু তাতে কোন নিয়মিত অংশগ্রহণের বাধ্যবাধকতা নেই। লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম, ভাল করে কথা বলতে পারতাম তাই স্কুল কমিটিগুলো করার সময় বা পাঠচক্রে উপস্থিত থাকি এটা সবাই চাইতো। কাজী রবিউল ভাইয়ের সাথে স্কুল কমিটি করতে বিভিন্ন স্কুলে গেছি। সাথে অনেক সময় আসাদুল থাকতো। আসাদুলের বোন বিউটির সাথে তখনও রবিউল ভাইয়ের বিয়ে হয় নি। বাইসাইকেলই তখন বাহন ছিল আমাদের।
একবার রামদিয়া যেতে হলো। স্কুলে যেয়ে অবাক হলাম। দেখলাম এই স্কুলের ছাত্ররা চলন বলনে অনেক আধুনিক, দেশ রাজনীতি সম্পর্কে তাঁরা জানেও অনেক। কারন কী হতে পারে এই যখন ভাবছি তখন রবিউল ভাই বললেন কারন ব্যারিস্টার সাহেব। রামদিয়া তাঁর গ্রাম। তাঁর কারনে গ্রামটার মননে আধুনিকতা আর উদারতার ছোঁয়া লেগে আছে। ফেরার পথে তাঁর বাড়িতে গেলাম। রাস্তার পাশে অনেকখানি খোলা জায়গা আর লম্বা একটা দেয়াল সমেত তাঁর বাড়িতে যেয়ে অবশ্য দেখা হলো না। তিনি বাইরে কোথাও ছিলেন।
মাটির রাস্তায় সরু হয়ে মিশে থাকা চিকন মসৃণ ট্রেইলের উপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসতে আসতে ভাবছিলাম, লোকটার সাথে তৃতীয় সাক্ষাৎ হলো না বটে, কিন্তু তার গ্রাম, তার বাড়ি সর্বোপরি তার প্রভাবে আলোকিত এই গ্রামের ভিতর দিয়ে তিনি যেন আমাকে আজ অনেকখানি দখল করে নিলেন।
প্রেক্ষাপট ৪
কলেজে ক্লাস শুরু হলো। জমজমাট কলেজ। মেয়েদের সাথে ক্লাস, কবিতা লেখা, দেওয়াল পত্রিকা-লিটল ম্যাগাজিন বের করা, সাংস্কৃতিক সংগঠন-লেখক শিবির করা, ছাত্রলীগের রাজনীতি করা, কারাটে অনুশীলন করা, আবৃত্তি করা, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করা এবং সবার উপরে আমার প্রথম প্রেমে পড়া – সে এক অপূর্ব উদ্দামতা। অসীম প্রাণময়তা।
তখন আমাদের কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন আড্ডা ছিল। এখন যেখানে অধিকারী মিষ্টান্ন ভান্ডার, মানে জগদীশ কাকার বাড়ির দরজার সামনে একটা টিউব ওয়েল ছিল। ঠিক তাঁর পাশে হারান দা’র চায়ের একটা টং দোকান ছিল। সেটাই তাঁর হোটেল ব্যবসার সুত্রপাত। উনি বিকালে বেগুনি বানাতেন। সামনে কয়েকটা লম্বা বেঞ্চ পেতে ওখানে আড্ডা হতো রাজনৈতিক। শহীদ ভাই ছিলেন এই আড্ডার মধ্যমনি। বাকি সবাই আমরা তাঁর চ্যালারা। শহীদ ভাইয়ের তখনো বিয়ে হয় নি। অদ্ভুত সম্মোহনী ক্ষমতা তাঁর। নিয়মিতদের মধ্যে প্রশান্ত দা, বিষু ভাই, লাল্টু, নজরুল ভাই (এরশাদপুর), নজরুল ভাই (রথতলা), শাহ আলম, হুজুর ভাই (মল্লিক), চুন্নু ভাই। হারান দা’র করুন চোখের চাহনী যখন অসহ্য হয়ে যেত তখন আড্ডাটা সরে যেয়ে ক্যানালের ধারে কালভার্টে যেয়ে বসতো।
অন্য আড্ডা ছিল অসীম আর্ট গ্যালারিতে। এখন যেখানে রুপালী ব্যাংক ভবন, ওখানে নিতাই পালের হোটেল ছিল। হোটেলের পাশেই ছিল আমার খুব ছেলেবেলার বন্ধু অসীম আর্ট গ্যালারী কাম লন্ড্রী শপ। ওখানে বস্তো বন্ধুদের আড্ডা। রানা, টগর, শরিফুল, সাবদার, মুকুল (গোবিন্দপুর), অটল এঁরা বসতো।
আরেকটা আড্ডা ছিল ‘ব্যারিস্টারের ছাউনি’। ব্যারিস্টার বাদল রশীদের বাড়ির সামনে, একটা ছোট্ট টালির দোচালা ঘর ছিল, রাস্তার ধারেই। এই ঘরটাতে একসময় খোন্দকার নাসিরুদ্দিন মঞ্জু একা একা থাকতেন, নিজেই রান্না করে খেতেন। ঘরটার ঠিক পেছনে একটা ছাউনিতে ব্যারিস্টার সাহেব আলমডাঙ্গায় থাকলে বসতেন। সাথে প্রায় নিয়মিত থাকতেন গোবিন্দপুরের রসুল জোয়ার্দার। ওখানে একটা আড্ডা।
এই তিন আড্ডাতেই আমি অংশ নিতাম।
ততোদিনে ব্যারিস্টার চাচার সাথে আমার ভালো মতো চেনা পরিচয় হয়ে গেছে। বেশি করে চিনেছি একটা ঘটনায়। কলেজের রাস্তাটা পাকা হচ্ছে, কিন্তু ইটের মান ভালো না। প্রতিবাদে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে CMLA বরাবর দরখাস্ত করলাম। এক নম্বরে স্বাক্ষর নিতে গিয়েছিলাম ব্যারিস্টার সাহেবের। তখন উনি অনেক ভাবে জেরা করে আমাকে চিনেছিলেন। ঐ দরখাস্তে স্বাক্ষর করেছিলেন শাফায়েত মিয়া, সাবু ডাক্তার সহ অনেকেই। তখন আলী আকবর নামে একজন মোটা গ্লাসের চশমা পরা সহকারী কমিশনার ছিলেন আলমডাআঙ্গায়। তিনি, সাথে জেলা পর্যায়ের তদন্ত কর্মকর্তারা, রাস্তার নির্মাণ তদারকিতে এসেছিলেন। রাস্তার মানোন্নয়ন ঘটেছিল।
যাহোক ১৯৮৪ (?) সালের বিজয় দিবসের আগে ব্যারিস্টার চাচা আমাদের বললেন, সামরিক সরকারের উদ্যোগে আয়োজিত বিজয় দিবসে আমাদের অংশ নেওয়া ঠিক হবে না। আমরা নিজেরাই বিজয় দিবস পালন করবো। কাঙ্গালি ভোজ হবে আর সন্ধ্যায় হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
উনার বাড়ির সামনে ঐ খোলা জায়গায় রান্না হলো খিচুড়ি। রাতে হলো আলোচনা গান কবিতা। নিচের ছবিটা অনুষ্ঠানের শেষে তোলা। কেউ কি কাউকে চিনতে পারেন?
