বাউল বেহাল শাহ -এর মূল্যবান পান্ডুলিপি বিলুপ্তির পথে।

352
বাউল বেহাল শাহ’র সমাধী
বাউল বেহাল শাহ’র সমাধী

লালনের অনুসারী কবি বেহাল শাহ এসেছিলেন ফরিদপুর গ্রামে। তখন তার বয়স ছিল ৩৫ বছর। তিনি মনস্থ করলেন, বাকি জীবন এই গ্রামেই কাটিয়ে দেবেন। গোল বাগানের অনতিদুরে গড়ে তুললেন তার বাউল আশ্রম।

ফরিদপুরের গোলবাগান

আলমডাঙ্গা শহর থেকে দু’মাইল দক্ষিন-পশ্চিমে অবস্থিত পাখি ডাকা ছায়া ঢাকা গ্রাম ফরিদপুর। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর রত্নগর্ভা এই গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন রনগাজী বিশ্বাস, বনমালী শাহের মত আনেক বাউল সাধক। এখানেই অবস্থিত সাধনার পাদপীঠ ঐতিহাসিক রনগাজী বিশ্বাসের গোলবাগান। অসংখ্য কিংবদন্তী প্রচলিত আছে এই বাগানকে কেন্দ্র করে। বৃত্তাকার বাগানের মাঝখানে দাড়িঁয়ে আছে একটা বকুল গাছ।

কথিত আছে, একদিন বাউল সাধক রনগাজী বিশ্বাস গাছটির তলায় ভক্ত পরিবেষ্ঠিত হয়ে বসে ছিলেন। পাশে সাদা কাপড় দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা, হঠাৎ সাধু সেই ঘরে প্রবেশ করলেন। ভক্তরা অধির আগ্রহে আপেক্ষা করতে থাকে, কখন সাধক বেরিয়ে আসেন। অপেক্ষার কোন ফল না হওয়ায় কাপড় তুলে তারা দেখতে পেলো সাধু ঘরের মধ্যে নেই। আছে একটা সুড়ঙ্গ।

ভক্তদের বিশ্বাস, এই সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে সাধু রনগাজী বিশ্বাস গুপ্ত হয়ে যান। সে সুড়ঙ্গ আজ তেমনি আছে। প্রতি বছর সেখানে শিরনি বিতরণ করা হয় ও সাধু সেবার মাধ্যমে রনগাজী বিশ্বাসের মৃত্যূ দিবস পালন করা হয়।

বেহাল শাহ -এর ৫২ বছর

ঐতিহাসিক এই গোল বাগানের আকর্ষনে লালনের অনুসারী কবি বেহাল শাহ এসেছিলেন ফরিদপুর গ্রামে। তখন তার বয়স ছিল ৩৫ বছর। তিনি মনস্থ করলেন, বাকি জীবন এই গ্রামেই কাটিয়ে দেবেন। গোল বাগানের অনতিদুরে গড়ে তুললেন তার বাউল আশ্রম।

এখানে মৃত্যূর আগ পর্যন্ত তার বৈচিত্রময় জীবনের ৫২ বছর কাটিয়েছেন অচিন পাখির সন্ধানে। এখানেই বসে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য মূল্যবান বাউল ও জারী গান, যা আজও বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার শিল্পীদের কন্ঠে শোনা যায়।

কবির বাল্যজীবন ও শিক্ষা জীবন সর্ম্পর্কে বিস্তরিত তেমন কিছু জানা যায়নি। তার বিধবা স্ত্রী হওয়া খাতুন এর বর্ণনা অনুযায়ী কবি কুষ্টিয়া জেলাধীন মিরপুর উপজেলার আইলচারা গ্রামে ১৩৩১ সানে জৈষ্ঠ্য মাসের কোন এক শনিবারে তার জন্ম হয়। কবির পিতার নাম বাহাদুর শহ। জন্মের পর কবি মাকে হারান।

মাতৃহারা এই শিশুর লালন-পালনের ভার গ্রহন করেন তার খালা। নিঃসন্তান এই মহিলা অসহায় শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে আসেন আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদাহে স্বামী ছমির উদ্দিন শাহ এর বাড়ীতে। স্বামী ও স্ত্রী মিলে আদর যত্ন করে শিশু বেহালকে লালন পালন করতে লাগলেন।

কবির খালু ছমির উদ্দিন শাহ ও ছিলেন একজন বাউল সাধক। এই মাহান সাধক বেহাল শাহকে সুফি সাধনায় দীক্ষিত করে তুললেন। বেহাল চিরদিন ছমির উদ্দিন শহকে দীক্ষা গুরুর মর্যাদা দিয়েছেন। তার রচিত প্রতিটি গানের শেষ চরণ গুরুর নামে উৎসর্গ করেছে

আরও পড়ুনঃ লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে যাওয়া আমাদের কুবির গোঁসাই।

বেহাল শাহ শুধু গান রচয়িতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সুরকার ও গায়কও। তার প্রতিদ্বন্দী গায়কের মধ্যে অন্যতাম ছিলেন অমূল্য শাহ। আজো বেহাল-অমূল্য জুুটির আনবদ্য কাহিনী এ অঞ্চলে মুখে মুখে ধ্বনিত হয়। মূল সুর রক্ষণের জন্য মকছেদ শহ এর তত্বাবধানে বাংলাদেশ বেতার বেহাল শহ এর অনেক লালনগীতি রেকর্ড করে রেখেছেন।

বাংলা ১৩৮৮ সনের ভাদ্র মোতাবেক ইংরেজী ১৯৮১ সালে ৫ই সেপ্টেম্বর শনিবার এই বাউল কবি মারা যান। মৃত্যকালে তার বয়স ছিলো ৮৭ বছর। তার বাউল আশ্রমের আঙ্গিনাতে তাকে কবর দেওয়া হয়। মরণের পরে রেখে গেছেন তার বিধবা স্ত্রী, কন্যা আয়েশা খাতুন ও অসংখ্য গুনগ্রাহীকে।

প্রতিবছর কবির মৃত্যুদিনে তার মৃত আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী জানানোর উদ্দেশ্যে বাউল সমাবেশ হয় বেহাল শাহ এর আশ্রমে। সাধু সেবা বলে কথিত এই অনুষ্ঠানে অঞ্চলের নামকরা শিল্পীরা একরাত একদিন ধরে পরিবেশন করেন বাউল সঙ্গিত। গ্রাম-গঞ্জের মানুষ সে সঙ্গীত আকঙ্ঠ পান করেন।

বেহাল শাহ -এর রচিত পান্ডুলিপি

বেহাল শাহ এর রচিত গানের সঠিক সংখ্যা নিরুপন করা কঠিন। এ যাবৎ তার গানের সামান্যতম অংশ বিভিন্ন গবেষকরা সংগ্রহ করেছেন। আর অধিকাংশ রচনা বাউল শিল্পীদের মুখে মুখে। লোক সাহিত্যের মূল্যবান এ সম্পদ সংগ্রহের উদ্যোগের অভাবে প্রায় বিলুপ্তির পথে।

কয়েক বছর এক আগে প্রায় শত খনেক গান সম্বলিত কবির নিজ হাতে লেখা দুটি পান্ডুলিপি আমার পড়ার সুয়োগ হয়েছিল। পুরাতন লেখার অনেক শব্দই অস্পষ্ট প্রায়। এখনই সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করলে হয়তো পান্ডুলিপি পাঠোদ্ধার সম্ভব হবে না। লোক সাহিত্যে গবেষনার দায়িত্বে নিয়েজিত প্রতিষ্ঠান সমূহের করনীয় হিসাবে এ্খনই পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।