স্কুল পালিয়ে, বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়লে লুকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিনেমা দেখতে যায়নি এমন লোকের সংখ্যা খুব কমই পাওয়া যাবে। স্কুল-কলেজ পালানোরা ভিড় করতেন বেলা ১২টা এবং ৩টা শো’তে। তাঁরা যে ধরা পড়তেন না এমনটা বলা যাবে না। সবাইই ধরা পড়েছেন। মা-বাবা ভাত বন্ধ করে দিয়েছেন, শিক্ষকরা বকা দিয়েছেন; কান ধরে ওঠ-বস করিয়েছেন, বেতের বাড়ি দিয়েছেন। এসব তাঁদেরকে আলমডাঙ্গা টকিজে বই দেখতে যাওয়া থেকে বিরত করতে পারেন। রূপালি পর্দার আমোঘ টানে আবার হলে গিয়েছেন। আবারও ধরা পড়েছেন; তাঁদের ভাত বন্ধ হয়েছে একবেলা, বকা খেয়েছেন, বেতের বাড়ি খেয়েছেন, ওঠ-বস করেছেন কান ধরে। আমাদের এই আয়োজনে থাকছে আলমডাঙ্গার সিনেমা হলের ইতিহাস
টকিজ সিনেমা, জয়া সিনেমা (আলমডাঙ্গার প্রথম হল)
আলমডাঙ্গার ঘরে ঘরে তখন টিভি ছিল না। ছিল বিরাট একটা হলঘরে বড়সড় একটা সার্বজনীন রূপালি পর্দা। পাঁচ টাকা-দশ টাকা দিয়ে একটা টিকেট কাটতে পারলে এই রূপালি পর্দা হয়ে যেত সবার। ঐ পর্দায় কলা করত স্বপ্নের নায়ক- নায়িকারা, যাদের রঙিন-সাদাকালো জীবনের সুখ দেখে মানুষ হাসত, কাঁদত তাঁদের দুঃখে, তাঁদের ঠোঁট মেলানো গানগুলো থাকত মানুষের মুখে মুখে; খলের ক্রূর চোখ দেখে, নির্মম অট্ট হাসি শুনে শরীরে খেলতো ভয়ে শিহরণ। সেই রূপালি পর্দার নাম আলমডাঙ্গা টকিজ। আলমডাঙ্গার মানুষের কাছে তখন ছিল স্বপ্নের মত একটা নাম। আর এখন নস্টালজির।
একটা রিক্সায় সামনে মাইক বেঁধে সামনে পেছনে ছবির পোস্টার ঝুলিয়ে পড়তেন তৎকালীন সময়ে ইউনুস মিয়া এবং পরবর্তীতে মরহুম ছানোয়ার। দরাজ কন্ঠে করতেন সিনেমার ক্যানভাস- হা ভাই আলমডাঙ্গা টকিজে চলিতেছে/ আসিতেছে নায়ক রাজ রাজ্জাক এবং বিউটি কুইন শাবানা অভিনীত মিষ্টি মধুর প্রেমের ছবি ইত্যাদি ইত্যাদি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, চায়ের দোকানে, চুল কাটানো স্যালুনে শোভা পেত সেই ছবির পোস্টার। হলের প্রবেশ পথের দেয়ালে সাঁটানো থাকতো কার্ড পোস্টার। নিখুঁত ভাবে ছাপানো ঐ কার্ড পোস্টার দেখে অনেকে দুধের সাধ ঘোলে মিটিয়ে নিত।
মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের লোকজন একসময় স্বপরিবারে যেতেন আলমডাঙ্গা টকিজে সিনেমা দেখতে। বাড়িতে অতিথি আসলে তাদেরকে নিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার একটা চল ছিল। মানুষ তাঁদের অতিথিদের নিয়ে যেতেন আলমডাঙ্গা টকিজে। শুধু সিনেমা দেখার উদ্দেশ্যে অনেকে গ্রাম থেকে আলমডাঙ্গা শহরে এসে তাঁদের আত্মীয়দের বাড়ি উঠতেন। তাঁদের গন্তব্যও ছিল আলমডাঙ্গা টকিজ। আলমডাঙ্গার কোনো নির্বাহী অফিসার আলমডাঙ্গার কোনো সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখছেন- এখন এমন চিত্র কল্পনা করাও অসম্ভব। কিন্তু আলমডাঙ্গা টকিজে আলমডাঙ্গার দু’একজন থানা/উপজেলা নির্বাহী অফিসার স্বপরিবারে সিনেমা দেখেছেন বলে জানা যায়।
আলমডাঙ্গা টকিজ সিনেমার খোরাক সবচেয়ে বেশী চাহিদা মিটিয়েছে আলমডাঙ্গার সাধারণ মানুষের, খেঁটে খাওয়া মানুষের। তাঁদের জন্য ওটাই ছিল তখন একমাত্র বিকল্প। সারাদিনের খাটা-খাটনি, বিকিকিনি শেষে অনেকেরই গন্তব্য হতো আলমডাঙ্গা টকিজ। দুই হাঁটবার- রবি এবং বৃহস্পতিবারে তাঁদের ভিড় বেশী দেখা যেত। অনেকে এই দুই দিন মোকাম করতে আসতেন। আর শুক্রবারে ভিড় বেশী হতো কারণ এইদিন পর্দায় নতুন সিনেমা উঠতো। আর ঈদের দিন টিকেট কাউন্টারের সামনে লেগে যেত ধুন্ধমার। এই যে আমরা এখন যমুনা নদীর উপর গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু সেতু নিয়ে গর্ব করি, সেটা গড়তে আলমডাঙ্গার অনেক মানুষ ‘যমুনা সেতু সারচার্জ’ দিয়েছেন এই আলমডাঙ্গা টকিজের মাধ্যেমে।
রাজ্জাক-কবরী জুটির বেশ পরে আসে সালমান শাহ্-শাবনুর জুটি। ঐ জুটির ট্র্যাজিক সমাপ্তির কিছু পরেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র প্রবেশ করে অশ্লীলতার যুগে। কালেভদ্রে একটি ভাল ছবি আর বাকিগুলোতে মানহীন গল্পের সাথে অশ্লীল কাটপিস। ৫০ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা শিল্প দু’চার বছরের মধ্যে ধ্বসে পড়ল। অনেক সিনেমা রসিক ঐ সময় নিজের অজান্তেই আলমডাঙ্গা টকিজে গিয়ে দেখলেন সবচেয়ে খারাপ সিনেমাটি। খারাপ অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা বাদ দিয়ে দিলেন। আলমডাঙ্গা টকিজ গৌরব হারাতে শুরু করল।
ইতিহাস থেকে জানা যাই ১৯৭২ সালে বাবু গঙ্গাধর জালানের কাছ থেকে লিজ নেওয়া গুদামঘরে কুমারখালি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা নুরে আলম জিকু সাহেবের হাতে গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক এই সিনেমা হল, কালিদাসপুরের কৃতিসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা অগ্নিসেনা খ্যাত সাবেক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন ছিলেন তৎকালীন ম্যানেজার, সবাই টকিজ বলে চিনে থাকলেও টকিজের হলের প্রথম নাম ছিল জয়া সিনেমা।
ঐতিহাসিক, ওরা ১১ জন, জীবন থেকে নেওয়া, ময়নামতি, রহিম রুপবান, বেদের মেয়ে জোসনা,অন্তন প্রেম, বাহাদুর আধুনিক কালে মনপুরা, প্রিয়া আমার প্রিয়া মতো ছবি টকিজ হলে পরিবেশিত এবং ব্যাপক জনপ্রিয় এবং ব্যাবসা সফল হয়েছিল। কয়েকবার হাত বদল শেষে বর্তমানে আলমডাঙ্গা টকিজ আছে জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে দর্শকের অভাবে বন্ধ হয়ে অনেকটা না থাকার মতো করে, আলমডাঙ্গার মানুষের কাছে একটি নস্টালজি হয়ে; কিছুটা কিম্বদন্তি হয়ে।
আঁখি সিনেমা হল (জামজামি)

কুমার নদ যেখানে আলমডাঙ্গা এবং কুষ্টিয়া জেলার সীমানা রচনা করেছে সেখানে জামজামি ইউনিয়নের ভৌগলিক অবস্থান। কাছেই কুষ্টিয়া সদর উপজেলার অংশ এবং ঝিনাইদহ জেলার হরিনাকুন্ড উপজেলা। এইসব দিক বিবেচনা করে জামজামি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম ডা.সোহরাব হোসেন জামজামি বাজারে তার মায়ের নামে ‘আঁখি সিনেমা হল’ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৯২ সালের এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৯৯৪ সালের প্রথম দিকে। ১৯৯৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রথম সিনেমা প্রদর্শিত হয়। নির্মাণে মোট খরচ হয়েছিল তৎকালীন সময়ে আনুমানিক ২০ লক্ষ টাকা। কার্যক্রম শুরুর প্রথম থেকেই আঁখি সিনেমা হল বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। আলমডাংগায় থেকে জামজামি ইউনিয়ন ও এর আশেপাশের গ্রাম, সংলগ্ন কুষ্টিয়া সদরের কিছু গ্রাম এবং ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ড অঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণ দর্শক এখানে আসতো সিনেমা দেখতে।
মাঝে মাঝে এতো বেশি দর্শক হতো যে বাইরের চায়ের দোকান থেকে বেঞ্চ নিয়ে যেয়ে দর্শকদের বসতে দিতে হতো। দর্শকরা নাকি একটু বসার জায়গা পেলেই খুশি। ভাল ছবিগুলোর কোনো কোনো শো’তে ৫০ থেকে ৬০ পারসেন্ট মহিলা দর্শকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত। আঁখি হলকে কেন্দ্র করে এর চারপাশে বেশকিছু হোটেল, চায়ের দোকান রকমারী খাবারের দোকানের রমরমা ব্যাবসা গড়ে উঠেছিল। সবচেয়ে ব্যাবসা সফল ছবি ছিল- বেদের মেয়ে জোসনা, সত্যের মৃত্যু নাই, দহন, আম্মাজান ইত্যাদি।
ডিশ এন্টিনা আসার পর এদেশের ঘরে ঘরে একপ্রকার সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল। মরার উপর খারার ঘা হিসাবে বাংলা সিনেমার অশ্লীল যুগে প্রবেশ, সারা দেশে সিনেমা হলগুলোতে পরিবেশ ধরে রাখার ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের কয়েক শত সিনেমা হলের মত আঁখি সিনেমা হলও ২০০৪/২০০৫ সালে বন্ধ হয়ে যায় এবং যন্ত্রপাতি সের দরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এটা এখন পরিত্যাক্ত অবস্থায় আছে।
(চলবে..)