গত দুই পর্বে আমি ডায়াবেটিস ও তার জটিলতা সম্পর্কে বলেছি। যদি আপনারা আমার লেখাগুলো পড়ে থাকেন, (না পড়ে থাকলে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপঃ ভয়ঙ্কর দু’টি নীরব ঘাতক পর্বঃ-১ ও পর্বঃ-২) তবে আশা করি বুঝতে পারছেন ডায়াবেটিস মোটেই কোন অবহেলা করার মত রোগ নয়। আজ আমি এর চিকিৎসার দিকগুলো সম্পর্কে ধারণা দেবার চেষ্টা করব।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা মোটেই খুব সহজ নয় এবং বেশ ব্যয়বহুলও বটে। কিন্তু এর চিকিৎসা না করা হলে অর্থাৎ ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা সৃষ্টি হলে তার চিকিৎসা খরচ বেশ কয়েক গুণ বৃদ্ধি তো পাবেই, বাড়বে ভোগান্তি, সেই সাথে হারাতে পারেন আপনার শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কোন অঙ্গ, এমনকি নিজের প্রাণটাও। এতএব ডায়াবেটিস যদি ধরা পড়ে তাহলে আর অবহেলা না করে চিকিৎসা নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
ডায়াবেটিস এর চিকিৎসাঃ
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা শুধুমাত্র ঔষধ খেয়ে সম্ভব নয়। ঔষধের পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবন ধারা এবং খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনেরও প্রয়োজন হয়। প্রাত্যহিক ব্যায়াম এবং শরীরের ওজন, রক্তচাপ ও রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ ডায়াবেটিস চিকিৎসার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এগুলোর প্রতিটি বিষয়েরই সুনির্দিষ্ট টার্গেট বা লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে অর্থাৎ এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো যদি অর্জিত হয় তবেই আমরা ধরে নিতে পারি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে। অনেক ডায়াবেটিস রোগী এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো না জানার কারণে তাদের ডায়াবেটিস পরিস্থিতি বুঝতে পারেন না।
ডায়াবেটিস চিকিৎসার লক্ষ্যমাত্রাঃ
একজন প্রাপ্তবয়স্ক ডায়েবেটিস রোগীর রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অভুক্ত অবস্থায়/খালিপেটে- ৬ এবং খাওয়ার পরে- ৮ মিলিমোল/লিটারের নিচে রাখতে হবে।
HbA1c ( এটা একটা পরীক্ষা যার মাধ্যমে গত ২-৩ মাসে গ্লুকোজের নিয়ন্ত্রন গড়ে কেমন ছিল তার একটা ধারণা পাওয়া যায়, তাই ডায়াবেটিস রোগীদের এই পরীক্ষাটি ৩ মাস অন্তর করা উচিত) ৭℅ এর নিচে রাখতে হবে। রক্তে LDL কোলেস্টেরল ১০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার এর নিচে এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা ১৫০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার এর নিচে রাখতে হবে।
রক্তচাপ, ১৪০/৮০ মিমি (পারদ) এর নিচে রাখা প্রয়োজন। এছাড়া উচ্চতার তুলনায় শরীরের ওজন একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় রাখতে হবে। অর্থাৎ অতিরিক্ত ওজন রাখা যাবে না।
(এই লক্ষ্যমাত্রা শিশু, বয়স্ক, গর্ভবতী এবং গুরতর অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে একই নয় বরং ভিন্ন।)
ডায়াবেটিস রোগীর খাবারঃ

ডায়াবেটিস রোগীর খাবার এমন হতে হবে যেন রক্তে সব সময় গ্লুকোজ একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্য থাকে অর্থাৎ হঠাৎ করে যেন অনেক বেশি বেড়ে না যায়। তাই প্রতিদিন যতটুকু খাবার খাওয়া প্রয়োজন তাকে আমরা ৬ টা সময়ে ভাগ করে নিতে পারি।
অর্থাৎ আমরা প্রধান তিনবেলার (সকাল, দুপুর, রাত) খাবার কমিয়ে আরো ৩ বেলা নাস্তার ব্যবস্থা করতে পারি, যেমনঃ সকাল ও দুপুরের খাবারের মাঝে (সকাল ১১ টার দিকে) ১ টা, বিকেলে ১ টা এবং রাতে ঘুমানোর আগে ১ টা নাস্তার ব্যবস্থা করতে পারি।
প্রতিদিনের খাবারে শর্করা ও চর্বি (স্নেহ) জাতীয় খাদ্যের উপস্থিতি কমাতে হবে এবং শাকসবজির পরিমাণ বাড়াতে হবে। যেসব খাবার হঠাৎ করে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় যেমন গ্লুকোজের শরবত, চিনি বা মিষ্টি জাতীয়/যুক্ত খাবার, মধু, জ্যাম, চকলেট খুবই কম খেতে হবে। ধুমপান এবং মদ্যপান পরিহার করতে হবে।
খাবারের ব্যাপারে, ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর পরই একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া ভাল।
শারীরিক ব্যায়ামঃ
ডায়াবেটিস রোগীদের বয়স ভেদে এবং শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ব্যায়ামের ধরণ ভিন্ন হতে পারে। তবে মোটামুটিভাবে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট করে মধ্যম গতিতে হাটা প্রয়োজন। এটা সপ্তাহে কমপক্ষে ৫ দিন হতে হবে এবং বিশেষ অসুস্থতা ব্যতীত কখনোই পরপর ২ দিন বন্ধ করা উচিত নয়। রক্তচাপ খুব বেশি থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত বেশি পরিশ্রমের ব্যায়াম বন্ধ রাখা উচিত।
ডায়াবেটিসের ঔষধঃ
ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় আমরা দুই ধরনের ঔষধ ব্যবহার করে থাকিঃ মুখে খাওয়ার ঔষধ আর ইনসুলিন ইঞ্জেকশন। এই দুই ধরনের আবার বিভিন্ন প্রকরণ রয়েছে। অনেক গুলো বিষয় যেমনঃ বয়স, শরীরের ওজন, ডায়াবেটিসের মাত্রা প্রভৃতি বিবেচনা করে ডায়াবেটিসের ঔষধ নির্বাচন করা হয়ে থাকে।
ডায়াবেটিস রোগীর যত্নঃ
ডায়াবেটিস রোগীর শারীরিক যেকোন ছোট খাটো সমস্যার ব্যাপারেও অধিক যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। তাদের ছোট খাটো সমস্যা-ই অনেক বড় সমস্যার জন্ম দিতে পারে। এক্ষেত্রে পায়ের যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডায়াবেটিস জটিলতায় অনেকের পায়ের অনুভূতি থাকে না। তাই পায়ে ক্ষত হলে তারা বুঝতেই পারেন না তাদের পায়ে ক্ষত হয়েছে। না বুঝতে পারার কারণে এই ক্ষতই বড় ক্ষতে রুপ নেয়।
তাই পায়ের যত্নের দিকে নজর দিতে হবে এবং সঠিক পরিমাপের আরামদায়ক জুতা ব্যবহার করতে হবে।
দুঃশ্চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। যারা অধিক দুঃশ্চিন্তায় থাকেন তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সময়ই কঠিন হয়ে যায়।
ডায়াবেটিস নিয়ে যা না জানলেই নয়ঃ
- সারাবিশ্বে ডায়াবেটিস মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।
- ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ
- এ রোগের প্রথমদিকে কোন লক্ষণ নাও থাকতে পারে। তাই সবার উচিত অন্তত বছরে একবার রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ পরীক্ষা করে ডায়াবেটিস আছে কিনা নিশ্চিত হওয়া।
- এ রোগ মূলত শরীরের রক্তনালী ও স্নায়ুতে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়ে মারাত্মক জটিলতা তৈরী করে।
- ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা শুধু আর্থিক ক্ষতিই করে না বরং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করে অঙ্গহানি করতে পারে, এবং মৃত্যু ঘটাতে পারে।
- ডায়াবেটিস এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল হলেও একে অবহেলা করার সুযোগ নেই।
- এ রোগের শুরুতেই বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমাদের শরীরের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
- ডায়াবেটিস নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই চিকিৎসকের কাছে নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
(চলবে)