সালাতঃ আল্লাহ্‌র সাথে বান্দার মুনাজাত বইয়ের পর্যালোচনা।

20
Salat


কার্বোহাইড্রেট এবং প্রোটিন নির্ভর জীবনটা একরকম চলছিল। খুব ভাল ছিল যেমন বলা যাবে না, আবার খুব খারাপ ছিল এমনটাও বলা যাবে না। মধু এবং গরল সমান্তরালে প্রবাহমান ছিল বলা যায়। কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু কেন যেন খুব একঘেয়ে লাগতে লাগল। প্রাত্যহিক জীবনের সবকিছুকেই, সব সম্পর্ককে, এমন কি প্রার্থনাগুলোকেও। এরপর শুরু হলো অস্থিরতা। শুধু শুরুই হলো না, প্রতিদিন বাড়তে লাগল প্রবলভাবে। ছায়া ঢাকা শান্ত কোনো সবুজ পানির কোনো দিঘী থেকে হঠাৎ একটা মাছেকে তুলে চৈত্রের প্রচন্ডে দাবদাহে চৌচির কোনো শস্যহীন মাঠে ছুড়ে ফেললে যে স্থিতি হয়, আমার মনের অবস্থা অনেকটা সেরকম হয়ে গেল।

এই স্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য নানা রকমের চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হচ্ছিল না। ওই সময় হঠাৎ করেই এক অগ্রজ প্রবাস থেকে ফোন দিলেন। আমি তাঁকে সবকিছু খুলে বললাম। তিনি বললে, তুই আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাঃ) স্যারের ‘রাহে বেলায়েত’ বইটা পড়া শুরু কর। সব ঠিক হয়ে যাবে। বইটি সংগ্রহ করে পড়া শুরু করলাম। যতই পড়ি ততই মুগ্ধ হই। বইটির তৃতীয় অধ্যায় (সালাত ও বেলায়াত) পড়তে গিয়ে শিহরিত হই। সালাত (নামাজ) কেন এত সুন্দর এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত তা তাঁর বইয়ের এই অধ্যায়ে প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। নিরবিছিন্ন মনোযোগ এবং পরিপূর্ণ সমর্পণের মাধ্যমে সালাত আদায় করা হলে তার চেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারে না। আমি গাফেল ছিলাম।

নিজের সাথে নিজের জীবনের মধুগুলোকে আবার অনুভব করতে শুরু করলাম। সেই থেকে নামাজকে আরো সুন্দর, আরো প্রাণবন্ত করার চেষ্টা শুরু হলো। এই বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমদের কথা শুনি, বিভিন্ন বই এবং আর্টিকেল পড়ি, নামাজে নিজেকে আল্লার কাছে আরো সমর্পণ করার চেষ্টা করি। এরমধ্যে প্রিয় ইমদাদ ভাইয়ের লেখা ‘সালাতঃ আল্লাহ্‌র সাথে বান্দার মুনাজাত’ বইটি বের হলো। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররামে আয়োজিত ইসলামী বইমেলা থেকে বইটা সংগ্রহ করলাম। পড়তে গিয়ে বুঝতে পারি ২১৪ পৃষ্ঠার এই বইটি নামাজের মনস্তাত্ত্বিক স্থিতি সম্পর্কে নতুন নতুন (আমার কাছে) দোয়ার খুলে দিচ্ছে। নামাজের প্রতিটি স্থিতির নির্যাস আরো সুন্দরভাবে গ্রহণ করতে পারছি।

বইটির নামকরণই বলে দেয় নামাজ আসলে আল্লাহ্‌র সাথে বান্দার সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম। বিষয়টি আসলেই তাই। নামাজ সবচেয়ে সহজ এবং সার্বজনীন মাধ্যম। কারণ আল্লাহ্‌ এটাই আশা করেন যে মানুষ নামাজের মাধ্যমে তাঁকে ডাকবে, তাঁর কাছে সাহায্য চাইবে, তাঁর চুপিচুপি একান্তে সাথে কথা বলবে । বইটিতে নামাজের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়নি বরং নামাজে দাঁড়ানোর পর মানুষের মানসিক স্থিতি কেমন হবে, কতটা বিশুদ্ধ আবেগ এবং ভালবাসা নিয়ে আল্লাহ্‌র সামনে দাঁড়ালে সফলতা আসবে সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

দুই পর্বে বিভক্ত বইটির প্রথম পর্বে দুআ, মুনাজাত, সালাত কী, কেনো এগুলো অহর্নিশ করতে হবে, মহান আল্লাহ্‌ কেনো বান্দাকে দুআ করার জন্য ডাকতে থাকেন, কেনো তিনি সদা-সর্বদা মানুষকে প্রার্থনা করতে বলেন; এসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে নামাজের প্রতিটি পর্যায়ে যা যা করা হয় সেগুলোর গভীরের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যাতে নামাজ মুনাজাতে পরিণত হয়। যেমন তাকবীর তাহরীমার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সাথে বান্দার মুনাজাত শুরু হয় এবং সালাম ফেরানোর মাধ্যমে তা শেষ হয়, সাথে শেষ হয় আল্লাহ্‌র সাথে বান্দার বিশেষ সান্নিধ্যের। বইটি পড়লে বোঝা যায় সালাম ফেরানোর আগমুহূর্তে সৃষ্ট আবেগ অনন্য। খুব প্রিয় কারোর সান্নিধ্য সাময়িকভাবে ত্যাগ করার সময় যে আবেগের সৃষ্টি হয় তার থেকে হাজার গুণ তীব্র এই আবেগ। সেই কারণেই এটা অনন্য।

বইয়ের পরিশিষ্টে বেশকিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম আলোচনা হচ্ছে মহানবী (সাঃ) এর উপর দরূদ পাঠের গুরুত্ব। ইসলামী পরিভাষায় দরূদকেও সালাত বলা হয়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটাকে আমরা অনেকেই গুরুত্ব কম দিয়ে থাকি। ইমদাদ ভাই পবিত্র কোরআনের আয়াত এবং সহি হাদিসের মাধ্যমে দরূদ পাঠের গুরুত্ব তুলে ধরছেন। পুরা বইটাতেই তিনি আলোচ্য বিষয়গুলোকে পরিষ্কার ভাবে বোঝানোর জন্য পবিত্র কোরআনের আয়াত এবং সহি হাদিসের রেফারেন্স দিয়েছেন। শায়খ ইমদাদুল হক ভাইয়ের বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা আছে বিস্তর। সম্ভবত কাব্য চর্চাও করেন। এগুলো তাঁকে তাঁর এই বইটির ভাষা সহজ, প্রাঞ্জল এবং গতিশীল করতে সাহায্য করেছে। আমি তাঁর এই বইটির সফলতা কামনা করছি।

(বইটি এবারের একুশে বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে। প্রকাশনীর নামঃ স্বরে অ, স্টল নাম্বারঃ ১৭২)