শামীম আরা শিউলীর ক্ষুধা ও যাপনের গল্প বইয়ের পর্যালোচনা।

24
ক্ষুধা ও যাপনের গল্প

মধ্য-চল্লিশ পার করছি। বয়সটা খুব অদ্ভুত। এই সময় কায়ার থেকে ছায়ার দৈর্ঘ্য বড় হতে থাকে। না ফেরা যায় শৈশবে, না থাকা যায় বড় হয়ে; শক্ত আর অশক্তের দোলচালে কেমন যেন একটা মানসিক স্থিতি! শান্তি যেনো শুধু নস্টালজিয়ার ভেতরে। হিন্দি কবি আশুতোষ রানার একটা কবিতার চারটে লাইন এখন প্রায়ই মনে মনে আওড়াতে থাকি- বাচ্চে রেহে নেহি যা তে/ বড়ে হাম হো নেহি পা তে/ খাড়ে ভি রেহে নেহি পা তে/ তব বাছপান ইয়াদ আতে হ্যায়ঁ…

আমার নস্টালজিয়া আলমডাঙ্গাকে ঘিরে সবেচেয়ে বেশি। তাই আলমডাঙ্গার কেউ কিছু লিখলে, তা সাইবার স্পেসে হোক বা ছাপার অক্ষরে, পড়ার চেষ্টা করি। লেখককে মনে মনে ধন্যবাদ জানায়, আর দূর থেকে কামনা করি—তাঁর কলম আরো শক্তি অর্জন করুক। এই প্রবণতা থেকেই শামীম আরা শিউলীর ক্ষুধা ও যাপনের গল্প বইটি এবারের একুশে বইমেলা থেকে সংগ্রহ করি। এই বইমেলায় আমাদের আলমডাঙ্গার কোনো মেয়ের বই বের হচ্ছে শুনে খুব ভাল লেগেছিল।


বইয়ের শিরোনামের সাথে মিল রেখে Shamim Ara Sheuli তাঁর বইয়ের গল্পগুলো সাজিয়েছেন। এগুলোকে ঠিক ওই অর্থে গল্প বলা যাবে না, যে অর্থে আমরা ছোটগল্প এবং অণুগল্পকে সংজ্ঞায়িত করি। বরং এটা বলা বেশি নিরাপদ হবে—তিনি খুব সহজ সরল ভাষায় তাঁর নিজ জীবনের অনুভূতির কথাগুলো বলেছেন, যার শুরু তাঁর শৈশব থেকে আর শেষ হয়েছে তাঁর গতকালের যাপিত জীবনে এসে। আর এটা চলমান থাকবে জীবনের অন্তিম অবধি।


গত শতকের আশির দশকের দারিদ্রতার ভয়াবহ চিত্র আর খিদের কষ্ট উঠে এসেছে ‘ক্ষুধা’ নামক গল্পে, যা দিয়ে তিনি বইটি শুরু করেছেন। ক্ষুধার্তরা ওই সময় আমাদের খুব কাছেই থাকতো। তাদের সাথে আত্মিক ব্যবধান থাকতো খুবই কম, ফলে তারা হয়ে উঠাতো আপনজন। সময় আর জীবন-জীবিকার তাগিদ আমাদেরকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিলেও স্মৃতিতে তারা থেকেই যায়। মেঘের অণুর মতো যুতবদ্ধ হয়ে থাকার সময়গুলোর স্থান-কাল একসময় আমাদের নস্টালজিক করে দেয়। মনে করিয়ে দেয়—সম্পর্কের আধার হচ্ছে স্মৃতি। এমনকি একজন অনুপস্থিত হয়ে গেলেও সেই সম্পর্ক মুছে যায় না।


মরাগাঙ‘ গল্পটা পড়তে গেলে চিরচেনা আলমডাঙ্গার অনুভূতিগুলোকে পাওয়া যাবে, যা আমাদের সবার অনুভূতির সাথে মিলে যাবে। পান্তাভাত, শেয়াল রাজা রঘুনাথ, দুঃখিনী, আম কাহিনী, মায়ের কথা—এই গল্পগুলো ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। ‘শেয়াল রাজা রঘুনাথ‘ গল্পটা পড়ে মজা পেয়েছি। একসময় শিয়ালের হাত থেকে হাঁস মুরগী, ছাগল, বা আখক্ষেত বাঁচানোর জন্য শেয়াল নিধনের চল ছিল। লেখক এখানে শিয়ালের চোখ দিয়ে বিষয়গুলো দেখিয়েছেন। এটা পড়তে গেলে শিয়াল বিষয়ক যেসব গল্প আমরা আমাদের শিশুরাতগুলোতে নানি-দাদির কাছ থেকে শুনতাম, সেগুলো মনে পড়ে যাবে।
বৃদ্ধাশ্রম‘ শিরোনামের লেখাটিতে লেখকের নিজের সামাজিক একটা কাজে অংশগ্রহণের চেষ্টা এবং ‘হারজিৎ‘ শিরোনামের লেখাটিতে তাঁর নিজস্ব একটা প্রবণতার কথা এসেছে, যে প্রবণতা থেকে তিনি জীবনের এক পর্যায়ে বের হয়ে এসেছেন। ঢাকা টু কলকাতা, চা অথবা পাহাড়ের কাছে, সমুদ্র ডেকেছিল বারবার এবং সাগরকন্যা কুয়াকাটায়—এই চারটি লেখা ভ্রমণ বিষয়ক। ভ্রমনের খুঁটিনাটি বর্ণনা, লেখকের অনুভূতি ইত্যাদি পড়তে মন্দ লাগবে না।


এটা লেখকের প্রথম বই। বইটিতে লেখকের নিজের কন্ঠস্বর চেনার একটা প্রচ্ছন্ন চেষ্টা লক্ষ করেছি। নিজের কণ্ঠস্বর চেনার প্রবণতা যেকোনো লেখকের জন্য একটা শুভ প্রবণতা। আশা রাখি তাঁর পরবর্তী বইগুলোতে তাঁর কণ্ঠস্বর আরো স্বকীয়তা অর্জন করবে, তাঁর কলম আরো শক্তিশালী হবে। লেখকের জন্য শুভ কামনা।