যখন প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করতাম, তখন আলমডাঙ্গার আকাশে দু’জন কিংবদন্তি শিক্ষক তারার মত জ্বলজ্বল করছিলেন- আলমডাঙ্গা পাইলট হাইস্কুলের শ্রদ্ধেয় আবুল হোসেন স্যার এবং এরাশদপুর একাডেমির মোহাম্মদ সোলায়মান স্যার। একজন গণিতের, অন্যজন ছিলেন ইংরেজির কিংবদন্তি। আমি অবশ্য তাঁদেরকে কিংবদন্তি বলতে আগ্রহী নই, কারণ বাংলাদেশে একবার কেউ কিংবদন্তি হয়ে গেলে তাঁকে আর কিছু করতে টরতে হয় না। বসে বসে খাওয়া যায়। কিন্তু এই দুজনই ছাত্রদের জন্য কাজ করতেন প্রচুর, ছিলেন অসম্ভব পরিশ্রমী। তাই আমি তাঁদেরকে পরিশ্রমী শিক্ষকই বলব।
সোলায়মান স্যারকে প্রথম দেখি এরশাদপুর স্কুলের ছাত্র সমাবেশে দাঁড়িয়ে। কোট-পান্ট-টাই পরা শক্তপোক্ত গড়নের একজন মানুষ প্রবল ব্যক্তিত্ব নিয়ে দাড়ালেন আমাদের সামনে। পাশ থেকে এক বন্ধু বলল, ইনিই সোলেমান স্যার। ‘সোলেমান স্যার’ নামে বেশী পরিচিত হলেও এই নামটা তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। তাঁকে ‘সোলেমান’ নামে সম্বোধন করা হয়েছে, এমন অনেক চিঠি না পড়েই ছুড়ে ফেলে দিতে দেখেছি।
ক্লাস সিক্সের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাসে তিনি আসলেন। প্যারাগ্রাফ পড়া ছিল। অনেকেই পড়া পারল না। তিনি তাঁদেরকে মৃদু বকা দিলেন, পরের ক্লাসগুলোতে পড়া না পারলে কঠোর হবেন বলে শাসালেন। টেন্স নিয়ে কিছু কথা বললেন। এক সময় ক্লাস শেষ হলো। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। পড়া না পারলে স্যার খুব মারধোর করেন বলে জানতাম। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। কোন দিনই এমনটা দেখিনি। তবে বেয়াদবি করার কারণে কাউকে কাউকে মেরেছেন।
দু’দিন পর আব্বা আমাকে স্যারের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ছবির মত সাজানো-গোছানো বাড়ি। পরিস্কার-পরিছন্ন উঠোন। খিড়কী দরজা পেরিয়ে বাগান, সেখানে অনেক গাছপালা আর একটা পুকুর। টিউশান নিতে গেলে অবাধে ঢুকে যেতে পারতাম বাড়ির ভিতরে কিংবা পেছনের বাগানে। মাঝে মাঝে শেষ বিকেলে বাগানের একটা ঘরে আমাদের পড়াতেন। অসহ্য সুন্দর সব স্মৃতি।
প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় উঠতেন। অযু গোসল সেরে ফজরের নামাজ। তারপর লেখার টেবিলে। বই লিখতেন, ছাত্রদের জন্য নোট লিখতেন, স্কুলের দপ্তরিক কিছু কাজ সেরে নাস্তা করে আমাদের পড়াতে বসতেন। পড়ানো শেষ হলে স্কুলের দিকে রওনা দিতেন। বাঁধা সময়ের বাইরে তাঁকে যেতে দেখিনি কখনই। ক্লাসে পড়ানোর সময় আন্তরিকতার কোন ঘাটতি কখনই দেখিনি।
বিকালে এক কি দুই ব্যাচ ছাত্রদের টিউশান দিয়ে আবার লেখার টেবিলে। প্রতিটি কাজ ছিল অত্যন্ত গোছালো। কোন এক সময় কেরু এন্ড কোম্পানির হিসাব বিভাগে কাজ করতেন, তাই মনে হয় স্কুলের দাপ্তরিক কাজগুলো করার সময় প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতেন খুব সাবধানে; যেন কাঁচের উপর দিয়ে হাঁটছেন। ডকুমেন্টেশান, ভাউচিং, ফাইল ইনডেক্সিং প্রতিট কাজেই ছিল প্রগাড় পেশাদারিত্বের ছাপ।
ইংরেজি বিষয়টা তিনি ছাত্রদের অজান্তেই তাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারতেন। যারা পরিশ্রম করতে পারত তাদের বিফল হওয়ার সুযোগ ছিল না। চর্চা চর্চা এবং চর্চা- এই ছিল একমাত্র অস্ত্র। তাঁর ছাত্রদের চর্চা করতে হতো অনেক বেশী। তিনি এরশাদপুর একাডেমীর প্রধান শিক্ষক হওয়ার আগেই স্কুলটির নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর স্কুলটি উৎকর্ষতার শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল।
মাটিতে পা দিয়ে চলতেন তিনি। জানতেন মানুষ চাঁদের আলো খেয়ে বাঁচে না। বাঁচতে হলে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ইত্যাদি লাগে। তাই বুঝি একদিন ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে বললেন, স্কুল তোদের স্যারদের বেতন দেয় প্রতি মাসের পাঁচ তারিখে। কিন্তু এই মাসে ফান্ডে কিছু ঘাটতি আছে। এখন তোরা যদি সবাই এক মাসের বেতন নিয়ে আসিস তাহলে আমি পাঁচ তারিখে তোদের স্যারদের বেতন দিতে পারব। পরের দিন প্রায় সবাই বেতন নিয়ে এল। বিকেলে দেখলাম স্যারদের চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক।
তাঁর ক্লাসের সময় হলে কিছু কিছু ছাত্র খামোখাই ক্লাস থেকে পালিয়ে যেত। তাদের ধারণা ছিল পড়া না পারলে স্যার বেদম মারবেন। কিন্তু পড়া না পারার কারণে কাউকে ওরকম ভাবে মারতে দেখিনি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে কোন এক সময় স্যার খুব ছাত্র পেটাতেন। কিন্তু বিএড ট্রেনিং করার পর আর তিনি অমনটা করতেন না। স্যারের পুত্র বন্ধু ডিউক এমনটাই আমাকে বলেছিল।
খুব ভাল একজন মেন্টর ছিলেন স্যার। অযুত ছাত্র তাঁর সংস্পর্শে এসে নিজেদেরকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। এই ক্ষেত্রে আমার বন্ধু টুটুলের কথা বলতে পারি। ওর গড়ে ওঠার পেছনে স্যারের অবদান ছিল খুব বেশী। টুটুল আজ বিশ্বমানের গবেষক। মাঝে মাঝে মনে হয় স্যার সময়ের থেকে অনেক বেশী এগিয়ে ছিলেন, বুঝি বা সময়ের আগে জন্মে ছিলেন। এখন তিনি থাকলে ভাল হতো। আসলে তাঁর মত শিক্ষককে সময় দিয়ে বাঁধা ঠিক হবে না। সব্ যুগেই তাঁদের মত শিক্ষক আমাদের দরকার হয়। আমরা একটু বেশী ভাগ্যবান ছিলাম।